‘আমার ছেলে তুহিন কালকে (বৃহস্পতিবার) বলেছিল, আমি তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাব। ডাক্তার অপারেশন করানোর কথা বললে, অপারেশন করাব। আম্মা কোনো চিন্তা করো না। তুমি ভালো হয়ে যাবে।’
বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে এসব কথা বলছিলেন গাজীপুরে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের ৭৫ বছর বয়সী মা সাবিহা খাতুন। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ৬ নম্বর ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামে তুহিনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মাকে এমন বিলাপ করতে দেখা যায়।
আসাদুজ্জামান তুহিনের স্ত্রীর নাম মুক্তা আক্তার। তাঁদের দুটি শিশুসন্তান রয়েছে। বড় ছেলে তৌকিরের বয়স সাত এবং ছোট ছেলে ফাহিমের তিন বছর। গত বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরের চান্দনায় দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে গতকাল সকাল থেকে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁর গ্রামের বাড়ি ভাটিপাড়ায় আসতে শুরু করেন।
ছেলের মৃত্যুর খবরে পাগলপ্রায় বৃদ্ধ বাবা মো. হাসান জামাল। ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। আহাজারি করে বলেন, ‘কী অপরাধ করেছিল আমার ছেলে? কী অন্যায় করেছিল সে? কেন এমন হলো? আমি কারও ক্ষতি চাই না। তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও।’ বলেন, ‘আমার ওষুধ কিনতে দুই দিন আগে টাকা পাঠিয়েছে। এ সপ্তাহে বাড়ি এসে মায়ের চোখের ছানি অপারেশন করতে গাজীপুরে নিয়ে যাবার কথা ছিল। এখন সেই ছেলে লাশ হয়ে বাড়ি আসতেছে। আমার সহজ সরল ছেলেটাকে তার মা বারবার বলেছে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিতে, কিন্তু ছাড়েনি। সেই সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমার ছেলে হত্যার শিকার হলো।’
স্বজনেরা জানান, আসাদুজ্জামান তুহিন গাজীপুরের ভাওয়াল কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ভাই জসিম উদ্দিনের ব্যবসায় যুক্ত হন। পরে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নেন। ২০১২ সালে ওষুধ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে সাংবাদিকতায় আসেন।
তুহিনের বড় বোন রত্না বেগম বলেন, ‘আমার ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করল। হত্যা না করে একটি হাত, একটি পা ভেঙে দিত। পঙ্গু করে দিলেও ভাই বেঁচে থাকত। আমার ভাইপুত দুজন এতিম হয়ে গেলে, স্ত্রী বিধবা। এদের সংসার এখন কীভাবে চলবে? সন্তানদের কে মানুষ করবে? হত্যাকারীদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী করছে? হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।’
জানা গেছে, গাজীপুর নগরীর চান্দনা চৌরাস্তায় বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে আসাদুজ্জামান তুহিনকে (৩৮) কুপিয়ে হত্যা করে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা। তারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করছিল। সাংবাদিক তুহিন সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করছিলেন। এর জেরে তাঁকে ধাওয়া করে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থলের একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এই তথ্য জানিয়েছে পুলিশ।
‘ছেলে বলেছিল, তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাব’, বুক চাপড়ে বলছেন তুহিনের মা‘ছেলে বলেছিল, তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাব’, বুক চাপড়ে বলছেন তুহিনের মা
তুহিনের সহকর্মী শামীম হোসেন বলেন, ‘চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় আমরা দুজন এক পাশ থেকে অন্য পাশে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এমন সময় কয়েকজন লোক দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে বলতে থাকে, এই পাইছি, তোরা আয়। ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাঁকে ধাওয়া করে। এ সময় তুহিন মোবাইল ফোন বের করে তাদের পেছনে দৌড় দেন। পরে আমি তুহিনকে খুঁজতে এগিয়ে যাই। অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছনে তাকায়। তুহিন দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকে যান। ঠিক ওই মুহূর্তে তারাও চায়ের দোকানে ঢুকে তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।’
ঘটনার পর রাতে নিহত তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম ও অপর এক ব্যক্তি বাদী হয়ে গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানায় দুটি মামলা করেন। গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ, উত্তর) মো. রবিউল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের ধারণা, একজনকে মারধরের ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় তুহিনকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।’